সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কলো ছোবল

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ।  শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের এই মাটি সম্প্রীতি পূণ্য ভুমি হিসেবে পরিচিত।  এই মাটিতেই মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান একই ঘাটের পানি খেয়ে বড় হচ্ছে। আজো বাংলাদেশে মুসলমানের কবর স্হানের জন্য হিন্দু আর হিন্দুর মন্দিরের জন্য মুসলমান জমি দান। হিন্দুর শবদেহ মুসলমানের কাঁধে চরে চিতায় যায় মুসলমানের লাশ হিন্দুর কাঁধে চেপে ও গোরস্থানে যাওয়ার নজির কম নয়। হঠাৎ করেই অনেক সময় আমাদের এই মাটি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই কলংকিত হয় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কালো থাবায়। ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এমন ঘটনা যা কোন ভাবেই কাম্য নয় এমন কি আমাদের সম্প্রীতির সাথে মানায় না। গত ১৮ই এপ্রিল এমনই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে ফরিদপুরের  মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে। যদি ও গ্রামটির নাম কৃষ্ণনগর তবে আশে পাশের মোট পাঁচটি গ্রাম নিয়েই মুলত এই এলাকার পরিচিত পঞ্চপল্লী গ্রাম নামেই।  পঞ্চপল্লীর গ্রাম গুলি হলো কৃষ্ণনগর, শিধলাজুড়ী, তারাপুর, জাননগর, কেষ্টপুর। এই পঞ্চপল্লী গ্রামের সকল বাসিন্দা ই সনাতন ধর্মাবলম্বী। এই পঞ্চপল্লী গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কৃষ্ণনগর গ্রামের পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নয়নের অংশ হিসেবে গত এক মাস যাবৎ বিদ্যালয় কমপ্লেক্সে একটি শৌচাগার নির্মানের কাজ চলছিল যেখানে মধুখালির ই  দুরের গ্রাম থেকে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করছিলেন যারা সকলেই ছিলেন ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম। তারা ঐ বিদ্যালয়ের ভিতরে একটি কক্ষে থেকেই কাজ করছিলেন। বিদ্যালয়ের পাশে ঘেঁষেই বটতলায়  বারোয়ারি কালী মন্দির। মন্দিরের ভিতরে উপাসনার জন্য কালী ও শিব মূর্তি সহ আরো দুটি মূর্তি আছে।  প্রতিদিনের মত ১৮ এপ্রিলও মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে আসেন মন্দিরের পাশের বাড়ীর তপতী রানী মণ্ডল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭টার দিকে মন্দিরের ভিতরে থাকা দেবী কালীর মূর্তির পরনে থাকা শাড়ীর আচঁলে আগুল লেগে যায়। মুহুর্তেই আগুনে কালী মূর্তির পরনের শাড়ি ও হাতে থাকা তীরশূল পুড়ে যায়। তপতী রানী মণ্ডল মন্দিরে প্রতিদিন যে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালান তা দেবী কালীর মূর্তির হাত খানেক সামনেই।  বৈশাখের আবহাওয়া তাই ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাহিরে কিছুটা বাতাস ও ছিল। মন্দিরে আগুন দেখে মুসলিম শ্রমিক ও পাশের হিন্দু বাড়ীর লোকজনে আগুন আগুন চিৎকারের আশপাশের শত শত লোক আগুন নেভাতে এগিয়ে আসেন। উপস্থিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মন্দিরে থাকা দেবী কালীর মূর্তির  পরনের শাড়ী ও হাতে তীরশূল পোড়া দেখে উত্তেজিত হয়ে পরেন। নিঃসন্দেহে একজন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ যখন তার উপাসনালয়ে উপাস্য দেবী মূর্তির এমন অবস্থা দেখবেন তাতে উত্তেজিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। একে একে পঞ্চপল্লীর পাঁচ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা ই ছুটে আসেন মন্দিরে। আর এই ধর্মীয় উত্তেজনাকে কাজে লাগায় কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্মীয় উগ্রবাদী। তারা উত্তেজিত জনতার মাথায় ঢুকিয়ে দেয় মন্দিরে আগুন দেওয়ার কাজটা পাশের বিদ্যালয়ের মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকরা ই করেছে। তাতে উত্তেজিত জনতা মারধরের উদ্দেশ্যে ঘিরে ফেলেন উপস্থিত মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকদের। এরই মধ্যে সাব ঠিকাদার জলিল শেখ নির্মাণ কাজের জন্য রড নিয়ে নিসমন নামের স্হানীয় যন্ত্রযান নিয়ে উপস্থিত হন।  উত্তেজিত স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগন নসিমনে থাকা রশি দিয়ে সাব ঠিকাদার জলিল শেখ নসিমন চালক লিটন খান ও নির্মাণ শ্রমিক আশরাফুল, আরশাদুল, সিরাজ শেখ, আনোয়ার হোসেনকে বেঁধে ফেলেন। স্হানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইউপি সদস্য অজিৎ কুমার সরকার ইউপি সদস্য লিংকন বিশ্বাস ও ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদুজ্জামান তপনের উপস্থিতিতেই স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগন নির্মাণ শ্রমিক সাব ঠিকাদার ও নসিমন চালকের উপর হামলা শুরু করে। এক পর্যায়ে স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ই কিছু উগ্রবাদীরা এতটাই ক্ষেপিয়ে তোলেন যে তারা রশি দিয়ে বাঁধা মুসলিন নির্মাণ শ্রমিক,  সাব ঠিকাদার ও নসিমন চালকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার জন্য উদ্বুদ্ধ হন। এই ঘটনায় উগ্র হিন্দু সাম্প্রতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণে জীবন হারাতে হয় আশরাফুল খান (১৭) ও আরশাদুল খানকে (১৫) নামের দুই কিশোর মুসলিম সহোদর নির্মাণ শ্রমিকে আর অত্যন্ত মারাত্মক ভাবে আহত হন বাকীরা। মন্দিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে এতটাই ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল যে স্হানীয় মধুখালি থানার পুলিশ উপস্থিত হলেও তারা আক্রান্ত মুসলিম শ্রমিকদের উদ্ধারের পরিবর্তে নিজেদের ও জিম্মি দশার মধ্যে পরতে হয় স্হানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগনের কাছে।  পরে আশেপাশে থানার পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি সদস্যরা দীর্ঘ সাত ঘন্টায় কয়েকশ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে  পঞ্চপল্লী এলাকার উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে ও ঐখান থেকে ভিকটিমদের উদ্ধার করতে সমর্থ হন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ওখান হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলি এতটাই অমানবিক হয়ে গিয়েছিল যে তারা দুইজন মাসুম নাবালকে পিটিয়ে মেরে উল্লাস করছিল।  তাদের বুক একটু ও কাঁপলো না যে পেটের দায়ে কাজ করতে আসা দুইটি শিশু বাচ্চারা তো আর ধর্মবিদ্বেষ কি তা হয়তো বুঝে না। বিদ্যালয়ে অবস্থানরত মুসলিম শ্রমিকরা নিশ্চয়ই অবগত যে তারা যেখানে আছেন সেটা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা এখানে কোন উদ্দেশ্যে তারা মন্দিরে প্রতিমার গায়ে আগুন দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন?  তারা অবশ্যই বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মন্দিরে প্রতিমার গায়ে আগুন দেওয়া বা ওখানে কোন অন্যায়ের ব্যবস্হা সম্পর্কে কিছুটা হলে ও ধারনা ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ঘটনার পর পর ই এক শ্রেনীর হিন্দু উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক আইডি থেকে নানা ধরনের উস্কানিমূলক পোস্টের মাধ্যমে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা লিপ্ত হয়েছিলেন । এর আগেও গত ১৯ ফেব্রুয়ারী চট্রগ্রাম আদালত চত্বরে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে নও মুসলিম এক তরুণকে বিয়ের জের ধরে যে উস্কানিমূলক স্লোগান শুনেছি তা সত্যি আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির জন্য এক ভয়ংকর শকুনের ই কালো ছায়া।

আমি আগেই বলেছি আমরা বাংলাদেশের মানুষ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আর এই চেতনাকে বিশেষ পূঁজি করে আমাদের অগ্রজের ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্র আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।  আমরা কখনোই চাইনা তাদের ত্যাগে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি কখনোই সাম্প্রদায়িক শকুনের থাবায় ছিন্নভিন্ন হউক।  কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই কিছু;দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি আমাদের সোনার বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ বাঁচিয়ে রাখার পায়তারায় ব্যস্ত।  এমনকি তারা অনেকটা স্বার্থক ও হয়েছে। তার কিছু প্রমান ও  আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার পর থেকেই ঐ অপশক্তি গুলি সক্রিয়। তারা কোন না কোন ছুতো তুলে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের পায়তারায় ব্যস্ত। ভারতের অযোধ্যাতে বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে ১৯৮৯ ও ৯০ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেনীর মুসলিম উগ্রবাদী গোষ্ঠী ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘড় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও মন্দিরে  হামলা চালিয়ে দেশকে এক অরাজক পরিস্থিতি দিকে ঠেলে দিতে চেয়ে ছিল।  এর পর একে একে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে কখনো ফেইসবুকে ধর্ম অবমানর ধোয়া তুলে কখনো মন্দিরে পবিত্র কোরান শরীফ রাখার কথা বলে।  তার প্রমান রামু,  নাসির নগর,  কুমিল্লা, পাবনার সাথিয়া সহ অনেক এলাকাই। এমনকি কখনো কখনো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ও আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও হামলার ঘটনার ঘটেছে।  তবে দুঃখ জনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কোন সাম্প্রদায়িক অঘটনের সুষ্ঠু ও সঠিক বিচার আজ ও পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।  যাও দুয়েকটা হয়েছে তা সবই শুধু মাত্র রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের জন্য।  সব সময়ই ই সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা ও মূল হোতারা রয়ে গেছেন ধরা ছোয়ার বাহিরে। নাসির নগরের রসরাজ দাস ফেইসবুকের ব্যবহার না জানলেও নাসিরে নগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা হয় ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে। কুমিল্লার পুজা মণ্ডপে পবিত্র কোরান শরীফ রাখার অভিযোগ এনে কুমিল্লা, চাঁদপুর,  রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা হয় ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে এমন কি আমরা দেখলাম মধুখালির ঘটনার পর সেই ফেইসবুক উস্কানি যা আমি আগেই বলেছি। আমি আগেই বলেছি আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য দেশীয়৷ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি ইন্ধন পুরনো কখনো আমরা একটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে স্লোগান  শুনিছি ” আমরা হব তালিবান, বাংলা হবে আফগান “।  আবার কখনো কখনো একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে ” অখণ্ড ভারত ” করার শপথ নিতে ও দেখেছি।  কিন্তু কোন এক অজানা কারনে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আজো বাংলাদেশের মাটিতে বুক ফুলিয়ে অহংকারে সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে কোন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির জায়গা হতে পারে না বা হতে দেওয়া যাবে না।

মন্তব্য করুন